
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে দাবি করা হচ্ছে যে, মালদার জালালপুরের ঐতিহ্যবাহী ৬২৯ বছরের পুরনো রথযাত্রা বন্ধ করেছে প্রশাসন। অনেকেই ফেসবুকে এই দাবিতে একটি গ্রাফিক কার্ড শেয়ার করছেন।
এই কার্ডে লেখা হয়েছে, "বিশেষ সম্প্রদায় সংখ্যায় বাড়লেই বন্ধ হয় সনাতনী উৎসব। সনাতনী সংখ্যাগরিষ্ঠ হুগলিতে রথযাত্রার ছবি। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত মালদায় বন্ধ রথযাত্রা। অথচ মাহেশের মতোই মালদার জালালপুরের রথযাত্রাও ৬২৯ বছর পুরনো। কারা যেন বলে? একই বৃন্তে দু'টি কুসুম।"
এই গ্রাফিক কার্ডটি পোস্ট করে কেউ কেউ লিখেছেন, "ভাবা যায় আফগান পাকিস্থান বাংলাদেশ এর মতো পশ্চিম বঙ্গে ও রথ যাত্রা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মুচলিম দের কারনে । তাও আবার বন্ধ করছে ব্রাহ্মণ ঘরের মমতা।"
আজতক ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান করে দেখেছে যে ভাইরাল দাবিটি পুরোপুরি সঠিক নয়। প্রত্যেক বছরের মতোই এ বছরেও জালালপুরে সাড়ম্বরে রথযাত্রা পালন করা হয়েছে। তবে রথের মেলায় প্রশাসনের বাধা ছিল। কারণ যে জমিতে মেলা হতো সেই জমি ছিল ব্যক্তিগত মালিকানাধীন এবং তিনি এই মেলা চাননি বলে পুলিশ দাবি করেছে।
সত্য উন্মোচন হলো যেভাবে
এই বিষয়ে কিওয়ার্ড সার্চ করা হলে হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। গত ২১ জুন প্রকাশিত, 'মালদায় ৬২৯ বছরের পুরনো রথের মেলা বন্ধ করে দিল মমতার পুলিশ' শীর্ষক এই রিপোর্টে লেখা হয়, মালদার কালিয়াচকের জালালপুরে এই রথযাত্রার অনুমতি পুলিশ দিয়েছে। তবে রথযাত্রার পাশাপাশি কয়েকদিন ব্যাপী যে মেলা অনুষ্ঠিত হয়, তার অনুমতি প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি।
এই রিপোর্ট থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয় যে রথযাত্রায় পুলিশের তরফ থেকে কোনও আপত্তি জানানো হয়নি। বরং রথের মেলায় আপত্তি জানানো হয়েছে।
এরপর আমরা সরাসরি আজতকের মালদা জেলার প্রতিনিধি মিল্টন পালের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাদের জানান যে নির্বিঘ্নে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই সঙ্গে তিনি মালদার জালালপুরে অনুষ্ঠিত রথযাত্রার বেশ কিছু ভিডিও আমাদের পাঠান যা নীচে তুলে ধরা হলো।
পাশাপাশি, বিস্তারিত জানতে আমরা মালদা পুলিশের অতিরিক্ত জেলা সুপার সম্ভব জৈনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সম্ভব বলেন, যে জমিতে মেলা অনুষ্ঠিত হতো, সেই জমিটি জালালপুর নিবাসী শংকর প্রসাদ চৌধুরীর ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পত্তি। তিনিই গত মে মাসে মালদা সদরের এসডিও অফিসে একটি দরখাস্ত করে প্রশাসনকে আবেদন জানান যেন তাঁর ওই জমিতে ধর্মীয় অনুষ্ঠান, অর্থাৎ রথযাত্রা ব্যাতীত কোনও ধরনের মেলা, অর্থাৎ দোকান-পসার না বসতে পারে। গত ১৪ মে তারিখের এই চিঠির ছবিও নীচে তুলে ধরা হলো। এই আবেদনের ভিত্তিতেই পুলিশ মেলার অনুমতি দেয়নি বলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।
তবে এ ক্ষেত্রে বলে রাখা দরকার, আলোচ্য মেলা কতটা এলাকাজুড়ে অনুষ্ঠিত হতো, এবং কতটা জমিতে উক্ত শংকর প্রসাদ চৌধুরীর মালিকানা রয়েছে, তা স্বাধীনভাবে আজতক বাংলা ফ্যাক্টচেকের পক্ষ থেকে যাচাই করা হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে মেলা উদ্যোগতারা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। জাস্টিস অমৃতা সিনহা মামলাটি শুনে রায় দেন। রায়ে তিনি বলেন, যেহেতু জমিটি একটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং রথযাত্রা ও উল্টো-রথে কোনও বাধা দেওয়া হয়নি, তাই মেলা অনুষ্ঠিত করার যে আবেদন জানানো হয়েছে, তার সপক্ষে আদালত কোনও রায় দিচ্ছে না।
এই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ফেসবুক পেজ থেকেও একটি পোস্ট করে লেখা হয় যে রথযাত্রা বন্ধ করা হয়নি। যেহেতু মেলা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমির ওপরে হয় তাই সেই জমির মালিকের NOC, অর্থাৎ অনাপত্তিপত্র ছাড়া এই মেলার অনুমতি দেওয়া সম্ভব নয়।
বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়রা জানান, রথযাত্রার ও উল্টোরথের অনুমতি পাওয়া গিয়েছে কিন্তু এতে তাঁরা সন্তুষ্ট নন। তারা চান এই ঐতিহ্যবাহী মেলা অনুষ্ঠিত হোক। কিন্তু ওই জমির মালিক শংকর চৌধুরীর বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগ, তিনি এই দেবত্তোর জমি নিজের পরিবারের নামে করে নিয়ে এখন সেটা বিক্রি করতে চাইছেন। যে কারণে এই জমিতে মেলা করতে দেওয়া হচ্ছে না। গত বছরও নাকি মেলা অনুষ্ঠিত হয়নি। এবং এই মেলা পুর্নজীবিত করতে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করছেন। স্থানীয়দের বক্তব্য নীচে তুলে ধরা হলো।
ফলে সব মিলিয়ে বলাই যায় সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল দাবিটি অর্ধসত্য। রথযাত্রার ক্ষেত্রে কোনও বাধা প্রশাসন দেয়নি, তবে মেলা করার ক্ষেত্রে আপত্তি জানানো হয়েছে।
(মালদা থেকে মিল্টন পালের ইনপুট সহযোগে)
মালদার জালালপুরের ৬২৯ বছরের পুরনো রথযাত্রা বন্ধ করে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন।
রথযাত্রার ক্ষেত্রে পুলিশ কোনও বাধা দেয়নি তবে মেলা বন্ধ রয়েছে। কারণ, যে জমিতে মেলা হতো তা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন এবং সেই জমির মালিক অনাপত্তিপত্র দেননি বলে দাবি পুলিশের।